
Md Mehedi Hasan
সময়ের সাথে সভ্যতা বদলায়, বদলায় মানুষের রুচি আর অভ্যাস। কিন্তু কিছু জিনিস এমন থাকে, যেগুলো প্রাচীনকালে তৈরি হলেও আজও মানুষকে পথ দেখায়। তেমনই এক অসাধারণ আবিষ্কার হলো অ্যাবাকাস। এটি এমন এক যন্ত্র, যা সুমেরিয়ার প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতা থেকে শুরু করে এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে!
মনে আছে ৭৯ বছর পূর্বে আবিষ্কার হওয়া বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার (ENIAC)-এর কথা? সেই সময়ে এই বিপ্লবী আবিষ্কার বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপনি কি এটি কিনবেন? আমার মনে হয় না আপনি সেটা করতে চান।
প্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে, গতকাল যা আবিষ্কৃত হয়েছিল তা আজ সেকেলে। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো, সমগ্র বিশ্ব এখনও প্রাচীনকালে তৈরি করা সেই প্রথম ক্যালকুলেটর ব্যবহারে তৃপ্তি খুঁজে পাচ্ছে। সহজভাবে বলতে গেলে– অ্যাবাকাস হলো মানব সৃষ্ট প্রথম ক্যালকুলেটর এবং কম্পিউটারের পূর্বপুরুষ। ১৫শ শতকের গণিতজ্ঞ লিওনার্দো ফিবোনাচ্চি তার বিখ্যাত কাজ "লিবার আবাচি"-তে অ্যাবাকাসের ব্যবহারকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সেই ধারণা থেকেই ১৬৪২ সালে ব্লেইজ পাস্কাল আবিষ্কার করেন যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর পাস্কালাইন। সময়ের পরিক্রমায়, এটি আমাদের আধুনিক কম্পিউটারের ভিত্তি স্থাপন করে।
বর্তমানে প্রযুক্তির যুগেও প্রাচীন অ্যাবাকাসের জনপ্রিয়তা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, জাপানসহ উন্নত দেশগুলোতে অভিভাবকরা সন্তানদের ব্রেইনের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মেধাবিকাশের মজাদার ও কার্যকর উপায় হিসেবে অ্যাবাকাস শেখাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। সঠিক উপায়ে অ্যাবাকাসের ব্যবহার শিশুদের মস্তিষ্কের উভয় পাশের সক্রিয়তা বাড়িয়ে তোলে। ফলে শিশুদের দুই হাতের সমান ব্যবহারের পাশাপাশি যে কোনো কাজে মনোযোগ, সক্রিয়তা, সমস্যার সমাধানের দক্ষতা ইত্যাদি বহু গুণ বৃদ্ধি পায়।
যুগ বদলালেও অ্যাবাকাস আজও মানুষের জীবনে এক অনন্য ভূমিকা পালন করছে। জানতে চান কীভাবে? চলুন, আমরা অ্যাবাকাসের গল্পে ডুব দেই!
প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীতে অংক-গণনা ছিল এক জটিল ও সময়সাপেক্ষ কাজ। খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ বছর আগে, এই চ্যালেঞ্জের সমাধান এল প্রাচীন ব্যাবিলন সভ্যতায়। ইউফ্রেটিস নদীর ধারে অবস্থিত ব্যাবিলন ছিল মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের অন্যতম সমৃদ্ধ নগর। এই নগর ছিল বাণিজ্য, কৃষি, প্রশাসনিক কাজ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। যেখানে এসব কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল দ্রুত এবং নির্ভুল হিসাব। মানুষের সেই প্রয়োজন মেটাতে তৈরি হলো অ্যাবাকাস—একটি সহজ, কিন্তু অসাধারণ কার্যকর গণনা যন্ত্র।
প্রাচীন ব্যাবিলনের গণিতবিদরা প্রথমে মাটি ও পুঁতির সাহায্যে একটি গণনা যন্ত্র তৈরি করেন। এভাবেই ব্যাবিলনীয় পণ্ডিতদের হাতে হয়ে যায় একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার, যা দ্রুত তাদের হিসাবের জটিলতা কমিয়ে গণনার এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।
অ্যাবাকাস ব্যাবিলনের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে যায় মিশর, গ্রিস, রোম, ভারত, এবং চীনে। প্রতিটি সংস্কৃতি নিজেদের মতো করে এটি উন্নত করেছে। চীনে এটি পরিচিত হয় "সুয়ানপান" নামে। একটি আয়তাকার কাঠামোর উপর সাজানো পুঁতি দিয়ে এটি জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করত। পরে জাপান এটিকে পরিপূর্ণতা দেয়। তাদের ‘সোরোবান’ শুধু গণনার যন্ত্র নয়, বরং শিক্ষার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ‘সোরোবান অ্যাবাকাস’ শিশুদের শেখার উপযোগী করে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যা তাদের মস্তিষ্কের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মেধাবিকাশে সহায়তা করে।
অ্যাবাকাস একটি চারকোনা আকৃতির যন্ত্র, যা সাধারণত প্লাস্টিক বা কাঠ দিয়ে তৈরি হয়। এর ফ্রেমে রয়েছে একাধিক রড, যার প্রতিটি রড বিভিন্ন মানের প্রতিনিধিত্ব করে। নিচের গুটিগুলো ১ এবং উপরের গুটিগুলো ১০,১০০ ও ১০০০ এর মান নির্দেশ করে। নির্দিষ্ট নিয়মে গুটিগুলোর অবস্থান পরিবর্তন করে, এটি দ্রুত এবং সহজে গাণিতিক গণনা সম্পাদন করতে সক্ষম। অ্যাবাকাসের এই সহজ, মজাদার ও কার্যকরী পদ্ধতি, শিশুদের গাণিতিক দক্ষতা উন্নত করার জন্য আদর্শ। নিয়মিত অ্যাবাকাসের ব্যবহার করলে এটি মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। ফলে গণনা করতে কোনো যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না; মস্তিষ্কই হয়ে ওঠে একটি গণনা যন্ত্র।
প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত, বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব ও প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি হয়েছে অ্যাবাকাসের সাতটি আলাদা ধরন। প্রতিটি ধরনের নকশা এবং ব্যবহার তার সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়েছে, যা মানুষের সৃজনশীলতার উৎকর্ষের প্রতীক। এখানে সাতটি ভিন্ন ধরনের অ্যাবাকাসের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো:
প্রযুক্তির এই যুগেও অ্যাবাকাস তার গুরুত্ব হারায়নি। আজকের আধুনিক সভ্যতায় এটি শুধু গণনার যন্ত্র নয়; বরং শিশুদের গাণিতিক দক্ষতা বৃদ্ধি, মেধাবিকাশ, মনোযোগ এবং বয়স্কদের স্মৃতিশক্তি উন্নত করার একটি কার্যকরী সমাধান। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, জাপানসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে অ্যাবাকাস বর্তমানে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বিশ্বায়নের এই যুগে অ্যাবাকাস শেখা আর কোনো একক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় শেখার এই প্রাচীন পদ্ধতিটি এখন পৌঁছে গেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। আগে যেখানে অ্যাবাকাস শেখার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে যেতে হতো, এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে ঘরে বসেই। এখন যে কেউ, বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে, অনলাইনেই অ্যাবাকাস শেখার চমৎকার এই সুযোগটি লুফে নিতে পারে।
১৯৯০-এর দশকে, জাপান, মালয়েশিয়া এবং চীনে পরিচালিত গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, অ্যাবাকাস শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের ব্রেইনের বিকাশ, মনোযোগ এবং গাণিতিক দক্ষতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। মালয়েশিয়ার SIP একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা কেলভিন থামের গবেষণায় দেখা যায় , অ্যাবাকাসের নিয়মিত অনুশীলন শিশুদের সমস্যা সমাধান এবং সৃজনশীল চিন্তা করার দক্ষতা উন্নত করতে সহায়তা করে, যা তাদের একাডেমিক এবং দৈনন্দিন জীবনে অপরিসীম উপকারে আসে।
অ্যাবাকাসের ব্যবহার কেবল শিশুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বয়স্কদের মস্তিষ্ককে সচল রাখতে এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। বিশ্বজুড়ে পরিচালিত গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, এটি বয়স্কদের মস্তিষ্কের নিউরনের কার্যক্রম বৃদ্ধি, মনোযোগ ধরে রাখা এবং ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে বিশেষ কার্যকর। বয়স্কদের মস্তিষ্ক উন্নয়নে অ্যাবাকাস নিয়ে কয়েকটি দেশের উদ্যোগ নিচে উল্লেখ করা হলো:
সাধারণত ৪-৭ বছর বয়সের শিশুরা সহজেই ২-৩ মাসের মধ্যে অ্যাবাকাসের মৌলিক ধারণা (যেমন যোগ-বিয়োগ) শিখতে পারে। এবং ৮-১৩ বছর বয়সী শিশুরা বেশি জটিল সমস্যা সমাধানে ২-৩ বছরের মধ্যে দক্ষতা অর্জন করতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে অ্যাবাকাস শেখার সবচেয়ে উপযুক্ত বয়স হলো চার থেকে ১৩ বছর। তবে বয়স্কদের শেখার ক্ষেত্রে সময় এবং প্রক্রিয়াগুলো শিশুদের থেকে আলাদা হতে পারে। তাদের শেখার ক্ষমতা অনেকটাই অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল। এজন্য সঠিক পদ্ধতি এবং পরিবেশ তৈরি করাই মুখ্য।
ছোট বয়স থেকে শিশুদেরকে অ্যাবাকাস শেখাতে মজারুতে তিনটি কোর্স রয়েছে।
মজারু শিশুদের অ্যাবাকাস শেখানোর জন্য অত্যন্ত কার্যকরী এবং মজাদার পদ্ধতি ব্যবহার করে, যেখানে শেখানো হয় খেলার মাধ্যমে। ফলে শিশুদের মেধাবিকাশ ও গণনার দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের মনোযোগ এবং সমস্যার সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় ৬ গুন পর্যন্ত।
নিচে মজারুর শেখানোর পদ্ধতির খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করা হলো:
মজারুর সকল ক্লাস অনলাইনে, মজারু অ্যাপের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এর ফলে, শিক্ষার্থীরা বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে, যে কোনো সময়, সহজেই মজারুর সাথে শিখতে পারে। প্রযুক্তির এ যুগে, মজারু একটি সহজ, সুলভ ও কার্যকরী শিক্ষার অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে, যা শিশুদের শেখার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
অ্যাবাকাস, প্রযুক্তির যুগেও, এখনো একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এটি শুধু শিশুদের মেধাবিকাশে সাহায্য করে না, বরং বয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে অ্যাবাকাস তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি, বরং এটি সকল বয়সের মানুষের চিন্তা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির পথে প্রেরণা দিচ্ছে।
প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগে অ্যাবাকাস ছিল শিশুদের মেধাবিকাশ, মনোযোগ, এবং গণনা দক্ষতা বৃদ্ধির একটি কার্যকরী পদ্ধতি। আপনি যদি চান আপনার সন্তান তার তীক্ষ্ণ মেধা ও অসাধারণ গাণিতিক দক্ষতা দিয়ে এগিয়ে থাকুক সবার চেয়ে তাহলে অ্যাবাকাস শেখানো তার জন্য হবে এক সেরা উপহার। মজারু আপনাকে সেই সুযোগ দিচ্ছে, যেখানে আপনার সন্তান ঘরে বসেই আধুনিক পদ্ধতিতে, মজার ছলে অ্যাবাকাস শিখতে পারবে। আজই আপনার শিশুকে অ্যাবাকাস শেখান, এবং দেখুন কিভাবে তার মস্তিষ্কের শক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়!