
QR কোড-এর হিজিবিজি জগতে স্বাগতম
ধরুণ দুই-তিন পাতার গাদা গাদা সব ইনফরমেশন সংরক্ষণ করতে হবে মাত্র ইঞ্চিখানেক জায়গার মধ্যে। কি ভাবছেন, বেশ তো মুশকিলে পড়া গেলো? এই মুশকিলই দিনের পর দিন অবলীলায় আসান করে চলেছে QR কোড বা Quick Response কোড।
ঠিক নামের মতোই QR কোড কিন্তু আমাদের জীবনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময় বাঁচানোর পাশাপাশি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনকেই করে তুলছে আরও সহজ। ধরুন তো আপনার নিকটস্থ কেউ ভীষণ অসুস্থ। যতো দ্রুত সম্ভব তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে টাকার প্রয়োজন। আপনি আপনার নিকটস্থ মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের মাধ্যমে তাকে টাকা পাঠাবেন। এখন আপনাকে সেই এজেন্টের নাম্বার বারকয়েক শুনে, ভুল হয়েছে কি না তা কয়েকবার চেক করে নিয়ে এরপর টাকা পাঠাতে কয়েক মিনিট লেগে গেলো। অথচ শুধুমাত্র একটি QR কোড স্ক্যান করেই এই কাজটি করা সম্ভব মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই। আর সাথে এজেন্টের নাম্বার শুনে বা দেখে টাইপ করার সময় ভুল হওয়ার ঝুঁকিটাও কিন্তু একদম শূণ্যের কোটায়। এভাবেই কয়েক ইঞ্চির এই সাদাকালো হিজিবিজি কোডটিই কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের জীবনটাকে আরও সহজ করে তুলছে।
ছোট্ট একটি QR কোড বিশাল সব তথ্য ধারণ করতে পারে অনায়াসেই
QR কোড সৃষ্টির ইতিহাস: আজকে QR এর কোড-এর আমরা যতো যতো ব্যবহার দেখতে পাই এর শুরুর গল্পটা কিন্তু মোটেও এরকম ছিলো না। আজ থেকে ২৭ বছর আগে ১৯৯৪ সালে QR এর কোড-এর জন্ম হয় বিখ্যাত জাপানিজ ইঞ্জিনিয়ার 'ডেনসো ওয়েভ'- এর হাত ধরে। ডেনসো সে সময়টায় কাজ করতেন এক জাপানিজ অটোমোবাইল কোম্পানিতে। কোম্পানিতে প্রতিদিনই বেশ কিছু গাড়ি, গাড়ির সাথে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি এসব তৈরি হতো। তাদের তৈরি প্রতিটি যন্ত্রপাতির তথ্য সংরক্ষণে সে সময় কোম্পানি বারকোড ব্যবহার করতো। তবে বারকোড-এর বেশকিছু সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত হওয়ায় সেসময় কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও বেশ খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়েন।
এমন অবস্থায় লম্বাটে সামান্তরিক আকৃতির বারকোড-এর পরিবর্তে বর্গাকৃতির নতুন এক কোড এনে সবাইকে চমকে দেন ডেনসো। ডেনসো আর এই কোডটিতে স্ট্যান্ডার্ড সব কোডিং মোডের সাথে নিউমেরিক, আলফা নিউমেরিক, বাইনারি এসব মোড যুক্ত করে সহজেই তথ্য সংরক্ষণের এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। দ্রুত স্ক্যান করার ক্ষমতার কারণে ডেনসো এই নতুন কোডটির নামকরণ করেন Quick Response বা QR কোড নামে। দ্রুত রিড করার ক্ষমতা আর বিশালাকৃতির সব তথ্য খুব সহজেই ধারণ করতে পারার সক্ষমতার কারণে অটোমোবাইলের পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পেও ডেনসোর এই QR কোড-এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। একসময় জাপানের গণ্ডি পেরিয়ে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে QR কোড। আর এখন প্রতিদিনই কোনো না কোনো কাজে QR কোড ব্যবহার করতে হয় না, এমন মানুষের সংখ্যাটা বেশ কম।
QR এর কোড-এর আবিষ্কারক বিখ্যাত জাপানিজ ইঞ্জিনিয়ার 'ডেনসো ওয়েভ'
QR কোড যেভাবে কাজ করে: আমরা দিনের পর দিন QR কোডকে বিভিন্ন কাজে অবলীলায় ব্যবহার করলেও QR কোড কীভাবে কাজ করে এ সম্পর্কে আমরা অনেকেরই ধারণা নেই। QR কোড হিসেবে আমরা সাদাকালো হিজিবিজি বিভিন্ন চিহ্নযুক্ত যে কোডটি দেখতে পাই এটি মূলত ক্যামেরা বা মেশিন দিয়ে স্ক্যান করতে পারার উপযুক্ত একটি ছবি। প্রতিটি QR কোডই বেশকিছু সাদা-কালো বর্গ ও বিন্দু দিয়ে তৈরি হয়, যেগুলো কি না বিশাল সংখ্যক ইনফরমেশন সংরক্ষণ করতে পারে। আমাদের মোবাইল ফোনের ক্যামেরা যখন এই QR কোডটিকে স্ক্যান করে তখন এই বিশেষ চিহ্নগুলোতে মানুষের বোধগম্য কোনো ভাষা, ছবি কিংবা ভিডিওতে রূপান্তর করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। সহজ করে বলতে গেলে, QR কোড বিভিন্ন ইনফরমেশনগুলোকে Encode করে এবং আমরা যখন সেই কোডটিকে মোবাইল ক্যামেরায় স্ক্যান করি তখন সেই ইনফরমেশনগুলোকে আমাদের সামনে বোধগম্য ভাষায় Decode করে থাকে QR কোড।
QR কোডের সহজ ব্যবহার বাঁচিয়ে দিতে পারে আপনার বেশ কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ সময়
QR কোড যেভাবে তৈরি করা যায়: QR কোড ব্যবহারের শুরুটা অটোমোবাইল শিল্প দিয়ে হলেও বর্তমানে এটি কম-বেশি সবধরণের ব্যবসায়ই ব্যবহার হচ্ছে। বিভিন্ন প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কেনার পর পেমেন্ট করার ক্ষেত্রেও QR কোড-এর ব্যবহার দেখা যায় হরহামেশাই।
এতো কিছু দেখে আপনারও কি মনে হচ্ছে ইশ! আমিও যদি একটি QR কোড বানাতে পারতাম? আফসোসের একদমই কারণ নেই। QR কোড বানাতে আপনার এখন QR Code Language শেখার কোনোই প্রয়োজন নেই৷ অনলাইনে বর্তমানে অসংখ্য QR Code Generator রয়েছে। এগুলো ব্যবহার করে আপনি খুব সহজেই দ্রুততম সময়ে আপনার মনমতো QR কোড বানিয়ে নিতে পারবেন।
QR এর কোড ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে সবসময়
QR কোড-এর নিরাপত্তা ঝুঁকি: QR কোড-এর ব্যবহার আর সুবিধা নিয়ে তো অনেক কথা হলো। এবার কিছুটা অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। আলোর নিচে থাকা অন্ধকারেরে মতোই QR কোডেরও বেশকিছু সমস্যা রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো নিরাপত্তাজনিত সমস্যা। QR কোড বানানো বেশ সহজলভ্য হওয়ায় হ্যাকিংসহ বিভিন্ন সাইবার অপরাধ সংগঠনের অন্যতম সহজ হাতিয়ার হলো QR কোড। ফিশিং লিংক কিংবা অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহারের চেয়ে QR কোড ব্যবহার করে সাইবার অপরাধীদের সফলতার হারও অনেক বেশি। কারণ QR কোডে স্ক্যানের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের প্রবণতার হার বেশি। অথচ অনেক সময়ই না জেনে-বুঝেই একটি QR কোড স্ক্যানের ফলেই আমাদের মহাগুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য থেকে শুরু করে পাসওয়ার্ড, এমনকি টাকা-পয়সা পর্যন্ত মুহূর্তেই হাতিয়ে নিতে পারে ওঁৎ পেতে থাকা হ্যাকাররা। তাই যেকোনো QR কোড স্ক্যান করার আগে বুঝে-শুনে সব যাচাই-বাছাই করে নেওয়াটা কিন্তু অবশ্য কর্তব্য।
লেখক: সাদিক শাহরিয়ার।
শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।