
সাদিক শাহরিয়ার
“চোখে গ্লিসারিন
অংক কী কঠিন রে দাদা
দাদা অংক কী কঠিন…”
উপরের লাইনগুলো পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত সংগীত ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গান — “অংক কী কঠিন”-এর। কিন্তু অংক কি আসলেই এতো কঠিন? আচ্ছা ওয়েট। এই আলোচনায় যাওয়ার আগে, অন্য আরেকটি আলোচনা সেরে নিই। আমরা যে বলি “অংক কঠিন”, এটা কি আসলে “অংক কঠিন” নাকি “গণিত কঠিন” হবে? দাঁড়ান, দাঁড়ান। মাথার মধ্যে অযথা প্যাঁচ লাগানোর দরকার নেই। একদম সহজ করে পুরোটা বুঝিয়ে বলছি।
গণিত প্রকাশের সাংকেতিক চিহ্নই হলো অংক। ০, ১, ২, ৩ এভাবে ৯ পর্যন্ত — এগুলো প্রতিটিই হলো একেকটি করে অংক। আবার এই অংকগুলোই একে অপরের সাথে বসে তৈরি করে সংখ্যা৷ যেমন অংক ১ আর অংক ৩ মিলে তৈরি করে সংখ্যা ১৩। কিন্তু তাহলে গণিত কাকে বলে? অংক, সংখ্যা এবং বিভিন্ন হিসাব চিহ্ন (+, -, ×, ÷) ব্যবহার করে যে সমস্যাগুলো তৈরি হয় তাদের সামগ্রিক বিষয়কে বলা হয় গণিত। তাই এবার থেকে যদি কঠিন বলতেই হয়, তাহলে আমরা আর বেচারা ০, ১, ২, ৩ এর মতো অংকের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে বরং আমরা বলবো “গণিত কঠিন।”
ছোটবেলায় এই গণিতের চক্করে পড়ে; মা-বাবার হাতে বেদম পিটুনি খেয়ে কতোই না চোখের পানি আর নাকের পানি এক করতে হয়েছে। কতোবার মনে হয়েছে, "ইশ! পৃথিবীতে যদি এই ম্যাথ নামক কিছু না থাকতো।" কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে পৃথিবীতে এই গণিত পৌঁছালোই বা কী করে?
গল্পের শুরুটা হয়েছিল আনুমানিক ৫৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। বর্তমান ইরাকের দক্ষিণ অংশ তৎকালীন সময়ে মেসোপটেমিয়া নামে পরিচিত ছিলো। সেখানেই ছিলো পৃথিবীর প্রথম সংগঠিত ও শহুরে বসবাসকারী মানবসম্প্রদায়। দৈনন্দিন প্রয়োজন ও ক্রয়-বিক্রয়ের চাহিদা থেকে সেখানে গণনা করার রীতি প্রচলিত হয়। যেহেতু তখনো কেউ লিখিত পদ্ধতির প্রচলন শুরু করেনি, তাই তারা একধরনের মাটির তৈরি পেরেক আকৃতির টোকেন উদ্ভাবন করে এবং প্রতিটি টোকেন দ্বারা একটি অংক বোঝানো হতো। শহুরে নাগরিকদের কর, রাজস্ব আদায়ের হিসাব-নিকাশ, পণ্যদ্রব্যের হিসাব, পশু গণনা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হতো এগুলো। এটাই ছিল গণিতের সূচনা।
পরবর্তীতে মিশরীয় ও গ্রিক সভ্যতার হাত ধরে ক্রমশ বিকাশ ঘটতে থাকে গণিতের। অ্যাডা লাভলেস, পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, আল খোয়ারিজমি, নিউটন, ফিবোনাচ্চির মতো গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীদের হাত ধরে চলতে থাকে গণিতের অগ্রযাত্রা। সৃষ্টি হয় অনুপাত, জ্যামিতি, বীজগণিত, অ্যালগরিদম ও বাইনারির। এরপর থেকে মানবসভ্যতাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আধুনিক গণিত ও প্রযুক্তি চর্চার মাত্রা ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে। কম্পিউটার থেকে শুরু করে হালের যেকোনো ডিজিটাল ইলেকট্রনিক ডিভাইস, আধুনিক সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছেই এই গণিতের ওপর ভিত্তি করে।
ছবি: অ্যাডা লাভলেস, পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, আল খোয়ারিজমি, নিউটন, ফিবোনাচ্চির মতো গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীদের হাত ধরে ঘটে গণিতের অগ্রযাত্রা
প্রতিদিনের জীবনে কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিল পরিশোধ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে গণিতের ব্যবহার অপরিহার্য। সময় মাপা, ওজন করা, দূরত্ব নির্ধারণ—সব ক্ষেত্রেই গণিতের প্রয়োজন। একটা সময় গিয়ে মানুষ বুঝতে পারলো তাদের দৈনন্দিন জীবন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে গেলে গণিত জানার কোনোই বিকল্প নেই। সেই সাথে গণিত মানুষের বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং যৌক্তিক চিন্তাভাবনাকে উন্নত করে। ফলশ্রুতিতে আমাদের প্রতিদিনের পড়ালেখায় যুক্ত হলো গণিত।
ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স, অর্থনীতি থেকে শুরু করে মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষাসহ মৌলিক জ্ঞান শাখার প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণিতের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই তো, একদম ছোট্ট বেলায় এক, দুই, তিন লিখতে শেখার মাধ্যমে সেই যে গণিতের যাত্রা শুরু হয়, এরপর সেটা চলতে থাকে জীবনভর। আর বর্তমান সময়ে আমরা যাচ্ছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০-এর মধ্য দিয়ে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ভবিষ্যতে মানুষ তাঁদের চাকরি হারাবে কি না, এটি বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। তবে ভবিষ্যৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে গণিতের গুরুত্ব কোনো অংশে কমবে না। কারণ, এই যুগের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হচ্ছে গণিতের ভাষার ওপর নির্ভর করেই। হয়তো ভবিষ্যতে কিছু ক্ষেত্রে রোবটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু মানুষের গণিত ব্যবহার কোনোভাবেই কম হবে না। যতো স্মার্ট প্রযুক্তিই আসুক না কেন, এটিকে পরিচালনার জন্য প্রোগ্রামিং প্রয়োজন হবে। আর প্রোগ্রামিংয়ের ভিত্তি স্থাপিতই হয়েছে গণিতের উপর নির্ভর করে। পাশাপাশি অটোমেশন, সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম, আর্টিফিশাল ইন্টিলিজেন্স (এআই), জেনারেল ইন্টিলিজেন্স (জিআই) ইত্যাদি বিষয়গুলোও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গে পরিণত হচ্ছে৷ আর এসব আধুনিক প্রযুক্তি পরিচালনায় গণিত শেখা ও গণিতে দক্ষতা অর্জনের কোনোই বিকল্প নেই।
ছবি: শিশুদের গণিত ভয় পাওয়ার প্রবণতাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘অ্যারিথমোফোবিয়া’
গণিত সহজও না আবার গণিত কঠিনও না। গণিত বরং গণিতের মতোই। গণিতের সহজ এবং কঠিন নির্ভর করে আমরা কীভাবে গণিত শিখছি তার ওপর। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা সূত্র ও মুখস্থ নির্ভর উপায়ে গণিত শেখায় আমাদের কাছে গণিতের মজাটা অনাবিষ্কৃত অবস্থায়ই থেকে যায়। মজা ও আনন্দ নিয়ে গণিত শেখার পরিবর্তে বরং না বুঝে মুখস্থ করার প্রবণতা — গণিতকে করে তোলে আমাদের কাছে ভীষণ কঠিন ও নিরানন্দময়। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এ্যাসেসমেন্ট, ৩৪টি দেশে জরিপ চালিয়ে দেখেছে — ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৩১% কিশোর-কিশোরী গণিত নিয়ে ভীষণ উদ্বেগে থাকে এবং ৬০% গণিতের ক্লাস করতেই উদ্বেগে ভোগে। শুধু শিশু বা কিশোর-কিশোরীরাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রাপ্তবয়স্করাও এই গণিত ভীতি নিয়ে জর্জরিত।
তবে এই গণিতের ভীতি দূর করা একান্ত জরুরী৷ আর এর জন্য প্রয়োজন সবার প্রথমেই মুখস্থ নির্ভর গণিত শেখা বেরিয়ে এসে গণিতের বাস্তব জীবনের প্রয়োগগুলি বোঝা এবং সেগুলো ব্যবহার করতে শেখা। গণিতকে কেবল সংখ্যা ও হিসাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ না করে বরং যুক্তি ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে গাণিতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলে গণিতের প্রকৃত মজা খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
শিশুদের গণিত ভয় পাওয়ার প্রবণতাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘অ্যারিথমোফোবিয়া’ (Arithmophobia)। বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়ুয়া শিশুদের মধ্যে গণিত ভীতি আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। আর এরজন্য দায়ী কিন্তু আমরা শিক্ষক এবং অভিভাবকরা। প্রথমত শিশুকে কখনোই এটা বলা উচিত নয় "গণিত অনেক কঠিন। তাই ভালো করে গণিত শিখতে হবে।" এতে করে গণিতের হাতেখড়ি হওয়ার আগেই শিশুমনে গণিত নিয়ে একধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তাই শিশুদের গণিত ভীতি দূর করার সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি শিক্ষক এবং অভিভাবকদেরই।
শিশুদের গণিত ভীতি দূর করতে যা করবেন:
গণিত শিক্ষক যত বেশি হাসিখুশি হবেন, শিক্ষার্থীদের জন্য গণিত শেখা তত সহজ হবে। শিক্ষককে অবশ্যই চক-ডাস্টার আর মার্কার-হোয়াইট বোর্ডের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ, বাস্তব উদাহরণ আর খেলনা ব্যবহার করে শিশুদের প্রাথমিক অবস্থায় গণিত শেখাতে। মনে রাখতে হবে প্রাথমিক অবস্থায় শিশুদের আনন্দ ও আগ্রহ নিয়ে গণিত শেখার স্পৃহা তৈরি করাই আমাদের প্রধান কাজ। শিশুর মনে গণিতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হলে শিশু নিজে থেকেই গণিতের অনুশীলন করতে থাকবে। আর বাস্তব উদাহরণ থেকে শেখা আর বারবার অনুশীলনের ফলে শিশু গণিতে দক্ষ হয়ে উঠবে। এছাড়াও গণিতের মজার খেলা, গণিতের বেসিক কিছু প্রশ্ন, ছোটদের গণিত কুইজ প্রশ্ন ও উত্তর ইত্যাদি শিশুদের সামনে গল্পের ছলে উপস্থাপন করলে শিশুরা গণিতকে লেখাপড়ার বদলে খেলা হিসেবে আবিষ্কার করবে।
শিশুমনে গণিতের ভীতি কাটিয়ে শিশুদের আনন্দ নিয়ে গণিত শেখাতে ও ওদের গণিতে দক্ষ করে তুলতে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি প্রতি বছর আয়োজন করছে গণিত উৎসব। প্রথম আলো ও ডাচ বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত এই গণিত অলিম্পিয়াড — সারা বাংলাদেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের গণিতের দক্ষতা বৃদ্ধিতে দারুণ ভূমিকা রাখছে। এধরনের গণিত উৎসবে অংশগ্রহণ শিশুদের মনে গণিতের ভীতি দূর করবে।
ছবি: গণিত অলিম্পিয়াড, গণিতের মজার খেলা, গণিতের বেসিক কিছু প্রশ্ন, ছোটদের গণিত কুইজ প্রশ্ন ও উত্তর ইত্যাদির মাধ্যমে গণিত শিখলে শিশুদের আত্মবিশ্বাস এবং গণিতে আগ্রহ দুই বাড়বে
বর্তমানে সচেতন অভিভাবকরা সন্তানদের যেমন এসব ম্যাথ অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়াচ্ছেন ঠিক তেমনই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ও এক্সপার্টদের সাহায্য নিয়ে সন্তানদের বছরব্যাপী গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য প্রস্তুতও করছে। গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ এবং এর প্রস্তুতি শিশুদের জন্য গণিতের দক্ষতা বৃদ্ধিতে দারুণ কার্যকর হতে পারে।
শিশুদের জন্য আনন্দময় লেখাপড়া নিশ্চিত করতে কাজ করছে মজারু। এরই অংশ হিসেবে প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের গণিত ভীতি দূর করতে এবং ওদের গণিতে আগ্রহী ও দক্ষ করে তুলতে কাজ করতে মজারুর একদল দক্ষ ইন্সট্রাক্টর। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের ম্যাথ অলিম্পিয়াডের জন্য প্রস্তুত করতে মজারুর রয়েছে ডেডিকেটেড ম্যাথ কোর্স।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য: ম্যাথ চ্যাম্পস (প্রাইমারি)
Course Link: https://mojaru.com/genius/Math-Champs-Primary\
নিম্ন-মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য: ম্যাথ চ্যাম্পস (জুনিয়র)
Course Link: https://mojaru.com/genius/Math-Champs-Junior
ভবিষ্যতের কম্পিটিটিভ পৃথিবীর জন্য আপনার সন্তানকে প্রস্তুত করতে — শৈশবে ওর ম্যাথের ভয় দূর করা এবং ওকে ম্যাথে দক্ষ করে তোলা আপনার একান্ত দায়িত্ব। আর এই জার্নিতে আপনাকে সাহায্য করতে সার্বক্ষণিক পাশে আছে মজারু।