
আপনাদের চলুন আজ এমনই এক জনগোষ্ঠীর সাথে পরিচয় করাই। 'লা গোমেরা' নামে আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম দিকে একটি দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। পাহাড়ঘেরা এই দ্বীপপুঞ্জের জনগোষ্ঠী একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করে শিস বাজিয়ে। শিসের শব্দের তরঙ্গে ওঠা-নামা কমিয়ে-বাড়িয়ে ভিন্ন ভিন্ন সব শব্দের মাধ্যমেই তারা তাদের ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে। 'লা গোমেরা' অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর এই ভাষা 'সিলবো' (Silbo) বা 'সিলবো গোমেরো' নামে পরিচিত। স্প্যানিশ 'সিলবো' শব্দের অর্থ হলো বাঁশি।
বৈচিত্র্যময় 'সিলবো গোমেরো' ভাষা
কি বেশ অবাক হচ্ছেন তাই তো? পৃথিবীতে কতো ধরনের ভাষা আছে তা নির্দিষ্ট করে বলাটা বেশ কঠিন, তবে সংখ্যাটা নেহায়েত সাত হাজারের কম নয়। এরমধ্যে কতো কতো যে এমন বিচিত্র আর রহস্যময় ভাষা রয়েছে তা আমাদের সকলেরই অজানা। দিন দিন প্রযুক্তিগত যতো উন্নতি ঘটছে, ততোই মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছুটছে আর তারই সাথে পাল্লা দিয়ে বিস্তৃতি ঘটছে বিভিন্ন ভাষার। বিশ্বায়নের এই জোয়ারে প্রতিনিয়ত বহুভাষী মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাই তো এখন নিজের মাতৃভাষা, আর ইংরেজি পারার পাশাপাশি তৃতীয় কোনো ভাষা শেখার দিকেও মানুষ ভীষণভাবে ঝুঁকছে। পৃথিবী জুড়ে ইন্টারন্যাশনাল ল্যাংগুয়েজ হিসেবে ইংরেজির চাহিদা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। তবে এবার চলুন একটা অজানা তথ্য জেনে নেওয়া যাক। পৃথিবীতে শতকরা মাত্র ২০ ভাগ লোক কথা বলে ইংরেজিতে৷ বাদ বাকি ৮০ ভাগ মানুষই কিন্তু কথা বলে অন্য কোনো ভাষায়।
ধরুন তো আপনাকে এমন এক দেশে পাঠানো হলো যেখানকার মানুষ মুখে কথাও বলে না, আবার অঙ্গিভঙ্গিও খুব একটা ব্যবহার করে না। তারা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করে কেবলমাত্র শিস বা বাঁশির মতো শব্দের মাধ্যমে। সে দেশে গিয়ে আপনার ভীষণ খিদে পেয়েছে৷ আপনি খিদের জ্বালায় মৃতপ্রায়। অথচ কেউ আপনার কথা কিংবা অঙ্গভঙ্গি কিছুই বুঝতে পারছে না, আপনাকে খেতেও দিচ্ছেনা। এদিকে খিদের যন্ত্রণায় আপনি তো ততোক্ষণে কান্নাকাটি পর্যন্ত শুরু করে দিয়েছেন। কী ভাবছেন, ধুর এও আবার হয় নাকি?
কেন শিখবো অন্য কোনো ভাষা?
আচ্ছা ঢাকার ফার্মগেটের রাস্তার কথা একবার চিন্তা করুন তো। কোচিং সেন্টারের পোস্টারের ভিড়ে আকাশের দেখা পাওয়াটাই ভীষণ দুস্কর। একটু ভালো করে খেয়াল করলেই দেখবেন একের পর এক সব IELTS, GMAT, GRE, TOFEL এসব পরীক্ষার প্রস্তুতির রং-বেরঙের সব পোস্টার। এসব ভাষা দক্ষতার পরীক্ষাগুলো উতরেই কিন্তু একজনকে কাজ কিংবা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে হয়। আর উচ্চশিক্ষা কিংবা চাকরি প্রত্যাশীদের বিদেশ গমনের এই লাইনটা কিন্তু দিনদিন বেড়েই চলেছে। তবে যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের বেশ বড় অংশই সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করেন, দেশ থেকে ইংরেজির দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে এলেও সেদেশের লোকজন মোটেও ইংরেজিতে কথা বলছে না। তারা তাদের নিজেদের ভাষায়ই কথা বলছে। আর তাই তো, ইংরেজি জানা সত্ত্বেও অনেকের জন্যই বিদেশে গিয়ে কথোপকথন কিংবা জীবনযাপন বেশ দূরহ হয়ে পড়ে। তাই কাজ কিংবা উচ্চশিক্ষা যে উদ্দেশ্যেই বিদেশে যাওয়া হোক না কেন, সে দেশের নিজস্ব ভাষা জানাটা কিন্তু আপনাকেই এনে দিতে পারে দারুণ সব সুবিধা।
তরুণদের মাঝে দিনদিন বাড়ছে ভিনদেশি ভাষা শেখার প্রবণতা
এতো গেলো নিজের সুবিধার কথা। অন্য কোনো দেশের ভাষা জানলে কিন্তু আপনার সামনেও উন্মোচিত হতে পারে দারুণ সব সুযোগ। বর্তমানে বেশ কিছু দেশ তাদের ভাষা জানে এমন লোকদের অভিবাসন দিতে ভীষণ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। চীন, জাপানের মতো দেশগুলোতে তাদের ভাষা জানে এমন শিক্ষার্থী কিংবা চাকরি প্রত্যাশীদের স্কলারশিপ, ভাতাসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশে রয়েছে বিভিন্ন দেশের অ্যাম্বাসি বা রাষ্ট্রীয় সদর দফতর। সম্মানজনক বেতন ও আরও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাসহ এইসব অ্যাম্বাসিতে বহুভাষীদের জন্য রয়েছে কাজের দারুণ সব সুযোগ। আর তাই তো, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ আরও অনেকেই বিভিন্ন ভাষা শেখার প্রতি ভীষণ আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
এছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশেও যেকোনো ভালো একটি চাকরিতে বহুভাষী মানুষ কিন্তু অন্যদের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে থাকছেন। আমরা সকলেই কম-বেশি জানি আমাদের দেশে চাকরির বাজার ঠিক কতোটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই চাকরির বাজারে বাংলা কিংবা ইংরেজির পাশাপাশি অন্য কোনো ভাষা জানার ফলে আপনি কিন্তু নিজেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে রাখতে পারেন। এর বাইরে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে নিয়মিতই ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ করতে হয়। ইংরেজি জানার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের ভাষা জানা লোকদের এইসব বহুজাতিক কোম্পানিতে রয়েছে ভীষণ কদর।
অন্য দেশের ভাষা জানলে সে দেশে চাকরি, উচ্চশিক্ষা, ভালো বেতন, কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার সুযোগ এসব বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা তো গেলো। এবার চলুন কিছুটা ভিন্নদিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। একটি দেশ, সেদেশের মানুষ সম্পর্কে গভীরভাবে জানার সবচেয়ে সুন্দরতম উপায়টিই হলো শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতি। আর একটি দেশের ভাষা জানার মাধ্যমেই সে দেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিশাল এক অজানা জগত উন্মোচিত হতে পারে আপনার সামনে। একবার ভাবুন তো বিদেশি কোনো এক নাগরিক, যে কি না বাংলা লিখতে-পড়তে জানে। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, হুমায়ূন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো একেকটি রূপকথার জগত আবিষ্কারের অবারিত সুযোগ তার সামনে। একটি দেশকে চেনার-জানার এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর কিই বা হতে পারে?
একটি দেশের শিল্প-সংস্কৃতি জানার পূর্বশর্ত সে দেশের ভাষা শেখা
কোন কোন ভাষা শিখবো?
পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যাটা যেহেতু সাত হাজারের বেশি তাই শেখা যেতে পারে যেকোনো ভাষাই। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আরবি, হিন্দি, উর্দু, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, জাপানিজ, চাইনিজ, রাশিয়ান, জার্মান, মালেশিয়ান, কোরিয়ান এসব ভাষা শেখার চাহিদাটা তূলনামূলক কিছুটা বেশি। তবে বিশ্বায়নের এই যুগে ভূ-রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং আরও বেশকিছু পারিপার্শ্বিক কারণে ভাষা শেখার চাহিদায়ও বেশ খানিকটা পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশে আজ থেকে বিশ-ত্রিশ বছর আগেও রাশিয়ান ভাষা শেখার চাহিদা ছিলো সবচেয়ে বেশি। তবে বর্তমানে রাশিয়ান ভাষা শেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশ খানিকটা কমে গিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ফ্রেঞ্চ, জাপানিজ, চাইনিজ, জার্মান এসব ভাষা শেখার প্রতি মানুষের আগ্রহের পরিমাণ বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে আপনি আপনার পছন্দ অনুযায়ী কোনো দেশের ভাষাই অনায়াসেই শিখে ফেলতে পারেন।
বাংলা বা ইংরেজিকে একক ধরে অন্য ভাষা শেখার প্রক্রিয়াটি সুবিধাজনক
তবে ভাষা যে কেবলমাত্র কোনো দেশেরই শিখতে হবে এমন কিন্তু কোনো কথা নেই। সাংকেতিক ভাষা বা সাইন (Sign) ল্যাংগুয়েজ, ব্রেইল-এর মতো ভাষাও কিন্তু আপনি চাইলেই শিখতে পারেন। মূলত শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সাংকেতিক ভাষা কিংবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়ালেখা ও অন্যান্য কাজে ব্রেইল ভাষা ব্যবহার করা হয়। এসব ভাষা জানার ফলেও কিন্তু আপনার সামনে উন্মোচিত হতে পারে দারুণ এক সম্ভাবনাময় জগত।
ভাষা শিখবো কোথায়?
ভাষা কেন শিখবো আর শিখে লাভই বা কি এসব নিয়ে তো অনেক কথা হলো। এবার চলুন দেখা যাক ভাষা শিখবোই বা কোথায়। আপনি আপনার হাতে থাকা মুঠোফোনটি ব্যবহার করে অনায়াসেই যেকোনো ভাষা শিখতে পারেন। বিনামূল্যে ভাষা শেখার জন্য বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ রয়েছে। আকর্ষণীয় সব কৌশল, ছবি দেখে, ভিডিওর মাধ্যমে আপনি চাইলেই খুব সহজেই এসব অ্যাপগুলো থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে আপনার পছন্দের ভাষা শিখতে পারবেন। ভাষাশিক্ষার বেশ জনপ্রিয় কিছু অ্যাপের মধ্যে রয়েছে: Duolingo, Memrise, Babbel, Busuu, Rosetta Stone, Drops, Mondly, Beelinguapp ইত্যাদি। এছাড়া ইউটিউবেও জনপ্রিয় সব ভাষাগুলোর উপর নিয়মিত ক্লাস পাওয়া যায়।
অনলাইনেই দারুণ সব অ্যাপে বিভিন্ন ভাষা শেখা সম্ভব একদম বিনামূল্যে
এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় সশরীরে, কোর্স আকারে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ভাষা শেখার সুযোগ রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইন্সটিটিউটে ১৪টি ভাষা শেখানো হয়ে থাকে। এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটিশ কাউন্সিল, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ল্যাংগুয়েজ ক্লাব ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় সুলভ মূল্যে বিদেশি ভাষা শেখা যায়।
এর বাইরে বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিদেশি ভাষা বিশেষত কোরিয়ান, জাপানিজ, ইরানিসহ আরও বিভিন্ন দেশের ভিন্ন সব ভাষার সিনেমা, ওয়েব সিরিজ, গান এসব দেখার প্রচলন রয়েছে। এর মাধ্যমেও অনেকেই খুব সহজেই বিনোদনের পাশাপাশি এসব ভাষা খুব দ্রুত রপ্ত করতে পারছে৷
ভিনদেশি ভাষার নাটক-সিনেমা থেকেও ভাষা শেখা যায় বেশ সহজে
তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে ভাষা শিক্ষার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ ও নিয়মিত চর্চার বিষয়। এক্ষেত্রে অবধারিতভাবে একটি প্রশ্ন চলে আসে, একজন মানুষের পক্ষে কি অনেকগুলো ভাষা শেখার মতো দূরহ কাজ সম্ভব? তবে শেষটি করছি জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর উদাহরণ দিয়ে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৭ টি ভাষা জানতেন। তিনি মনে করতেন ভাষা শিক্ষা ও ধর্মচর্চা পরম ইবাদত। তাই তো, ভাষা শিখতে আগ্রহী যেকেউ কিছুটা ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে পারলেই অনেকগুলো ভাষা শেখা খুব সম্ভব।
তবে ভিনদেশি ভাষা শেখার আগে নিজের ভাষার ভিতটা মজবুত হওয়াটাও কিন্তু বেশ জরুরী। কেননা ভিনদেশি কোনো বন্ধু যদি কখনো আমার থেকে আমার ভাষাটা শিখতে চায়, তবে না যেন আবার বিপাকে পড়তে হয়!
লেখক: সাদিক শাহরিয়ার
শিক্ষার্থী (ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Email: sadikshahriar23@gmail.com